হজ্বের অর্থ ও তাৎপর্য


9711
পাঠ সংক্ষেপ
বস্তুত হজ্বের দৃশ্য বড়ই বিস্ময়কর ও হৃদয়স্পর্শী। এ দৃশ্য দেখে মুমিনগণ আনন্দিত হন এবং একত্ববাদীগণ হন সম্মানিত ও গর্বিত। সেই সাথে অপরাধীরা হয় লজ্জিত এবং উদাসীনদের হয় দৃষ্টিভ্রম। এ সুবিশাল সমাবেশ ও মহান মিলনমেলা আমাদেরকে কোনো উপদেশ ও শিক্ষা না দিয়ে বিদায় নেবে তা হতে পারে না।

اَلْحَمْدُ لِلَّهِ جَعَلَ الْبَيْتَ مَثَابَةً لِّلنَّاسِ وَأَمْنَا وَأَمَرَ بِاتِّخَاذِ مَقَامٍ إِبْرَاهِيْمَ مُصَلَّى وَفَرَضَ عَلَى عِبَادِهِ حَجَّ الْبَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيْلاً، وَأَشْهَدُ أَن لَّا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ وَأَشْهَدُ أَنَّ مُحَمَّداً عَبْدُهُ وَرَسُوْلُهُ، أَمَّا بَعْدُ :

হজ্ব, মুমিনের মিলনমেলা

ডাকে তোমাকে হাতছানি দিয়ে,

ইব্রাহীমি আহ্বান নিয়ে

ডাকে শুদ্ধ হতে, ফিরে যেতে

নবজাতকের পবিত্রতায়।

মুহতারাম হাযেরীন! আপনারা কি হজ্ব ও তার বিশালত্বের বিষয়টি কল্পনা করেছেন? আপনারা কি দেখেছেন ঈমান ও তার সমুজ্জ্বলতা? লক্ষ্য করেছেন লোকদের বিরাট সমাবেশ, যারা বাইতুল্লাহ শরীফে আগমন করেছে আল্লাহর বড়ত্ব, প্রশংসা ও বুযুর্গী বর্ণনা করতে করতে?

বস্তুত হজ্বের দৃশ্য বড়ই বিস্ময়কর ও হৃদয়স্পর্শী। এ দৃশ্য দেখে মুমিনগণ আনন্দিত হন এবং একত্ববাদীগণ হন সম্মানিত ও গর্বিত। সেই সাথে অপরাধীরা হয় লজ্জিত এবং উদাসীনদের হয় দৃষ্টিভ্রম।

অতএব, হে মুসলমানগণ! আমার তো মনে হয় না যে, এই সুবিশাল সমাবেশ ও মহান মিলনমেলা আমাদেরকে কোনো উপদেশ ও শিক্ষা না দিয়েই বিদায় নিবে!

মক্কার পবিত্র ভূমিতে আল্লাহ তা‘আলার দাওয়াতে লোকদের এই বিশাল সমাবেশ সংঘটিত হয়। তারা উপস্থিত হয় আল্লাহ তা‘আলার শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা ও তার একত্ববাদের ঘোষণা দেয়ার জন্য। তাই যারা সামার্থ্য রাখে তাদের ওপর হজ্ব করে দিয়ে আল্লাহ তাঅ‘লা বলেন:

{ وَلِلَّهِ عَلَى النَّاسِ حِجُّ البَيْتِ مَنِ اسْتَطَاعَ إِلَيْهِ سَبِيلاً }

‘এবং সামর্থ্যবান মানুষের উপর আল্লাহর জন্য বায়তুল্লাহর হজ্ব করা ফরজ’ (সূরা আল ইমরান: ৯৭)।

হজ্বের সমাবেশ অনেক বড় সমাবেশ যা দেখে গোটা বিশ্ব কম্পিত হয়, ইসলামের দুশমনেরা ভীত-সন্ত্রস্ত হয় এবং ইহুদী-খৃস্টানেরা ঘাবড়ে যায়। এতে কি আপনারা এই দীনের শ্রেষ্ঠত্ব এবং এই উম্মতের মর্যাদার বিষয়টি উপলব্ধি করতে পারছেন না?

প্রিয় ভাইয়েরা! হজ্ব হলো উম্মতের বিক্ষিপ্ত হয়ে যাওয়ার পর পুনরায় একত্রিত হওয়ার ময়দান এবং অপদস্থতার পর ইজ্জত বা সম্মানের মিনারা স্বরূপ। শুধু তাই নয়, হজ্ব মুসলমানদের জীবন ও অস্তিত্বের আলামতও বটে। এ সত্ত্বেও উম্মতের জন্য কি এটা উচিত হবে যে, তারা হজ্বের মতো এই গুরুত্বপূর্ণ আমলের ভেদ ও রহস্য উদঘাটন করা থেকে নির্লিপ্ত থাকবে?

হজ্ব হলো পারস্পরিক বন্ধন সুদৃঢ় করা, ঈমানের নবায়ন করা এবং একে অপরের সাথে পরিচিত হওয়ার স্থান।

কেননা হজ্ব করতে এসে এক মুসলমান দূরের আরেক মুসলমানের সাথে পরিচিত হয়, তার কথা শুনে এবং সাহায্যের মুখাপেক্ষী হলে তাকে সাহায্য করে।

হে আল্লাহর বান্দাগণ! হজ্বের রহস্য ও ভেদ জানার জন্য প্রয়োজন হলো হজ্ব সম্পর্কিত আয়াতগুলো সম্পর্কে সম্যক অবগতি লাভ করা।

আল্লাহ তা‘আলা বায়তুল্লাহ শরীফের বুনিয়াদ রেখেছেন যাতে মানুষ তার একত্ববাদের স্বীকৃতি দেয় এবং তার ইবাদত করে। যেমন তিনি বলেন:

{ وَإِذْ بَوَّأْنَا لإِبْراهِيمَ مَكَانَ الْبَيْتِ أَن لاَّ تُشْرِكْ بِى شَيْئًا وَطَهّرْ بَيْتِىَ لِلطَّائِفِينَ وَالْقَائِمِينَ وَالرُّكَّعِ السُّجُودِ }

‘আর স্মরণ কর, যখন আমি ইবরাহীমকে সে ঘরের (বায়তুল্লাহ্র) স্থান নির্ধারণ করে দিয়েছিলাম এবং বলেছিলাম, ‘আমার সাথে কাউকে শরীক করবে না এবং আমার ঘরকে পবিত্র রাখবে তাওয়াফকারীদের জন্য, নামাযে দণ্ডায়মানদের জন্য এবং রুকু সেজদাকারীদের জন্য’ (সূরা হাজ্জ: ২৬)।

নিশ্চয় খালেস ও নির্ভেজাল একত্ববাদ আল্লাহর এই যমীনে মানুষের খিলাফতের ভিত্তি এবং সর্বোৎকৃষ্ট ও মহিমান্বিত একটি বিষয়। বস্তুত নির্ভেজাল একত্ববাদই পারে গোটা মানবজাতিকে আল্লাহ তা‘আলার যাত ও সিফাতের মধ্যে শিরক করা থেকে নিরাপদ রাখতে।

একত্ববাদে বিশ্বাসী ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার কাছ থেকেই কিছু পাওয়ার আশা রাখে, তাকেই সে ভয় পায় এবং তার কাছেই সে সাহায্য প্রার্থনা করে। উপরন্তু সে এটাও কামনা করে যে, আল্লাহর যমীনে যেন আল্লাহর বিধান প্রতিষ্ঠিত হয়, তাঁর বিধি-বিধানই কার্যকর হয়।

হজ্বের অন্যতম শিক্ষা হলো তাওহীদ। হজ্বের প্রতিটি বিধানই তাওহীদী ভাবধারাকে আন্দোলিত করে তোলে মুসলিম উম্মাহর হৃদয়রাজ্যে।

বায়তুল্লাহর তাওয়াফের সময় আমরা হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করি অথবা স্পর্শ করি অথবা হাজরে আসওয়াদের দিকে ইশারা করি। রাসূলুল্লাহ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণার্থেই আমরা কেবল এরূপ করি। তাছাড়া হাজরে আসওয়াদের আলাদ কোনো বরকত নেই। হাজরে আসওয়াদ কেবলই একটা পাথর মাত্র যা উপকার অপকার কোনোটাই করতে পারে না। উমর রাযি. তার ভাষায় উক্ত বিষয়টিকে খুব সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলেছেন। তিনি বলেন:

( إِنِّي أَعْلَمُ أَنَّكَ حَجَرٌ لَا تَضُرُّ وَلَا تَنْفَعُ، وَلَوْلَا أَنِّيْ رَأَيْتُ رَسُوْلَ اللَّهِ يُقَبِّلُكَ مَا قَبَّلْتُكَ )

‘ আমি জানি, তুমি একটি পাথর বৈ কিছু নও। তুমি না কোনো ক্ষতি করতে পারো, না কোনো উপকার করতে পারো। যদি আমি এটা না দেখতাম যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তোমাকে চুম্বন করেছেন তাহলে কখনোই আমি তোমাকে চুম্বন করতাম না’।

অতএব একথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস রাখা প্রত্যেক মুসলমানের উচিত যে, বায়তুল্লাহর তাওয়াফ, হাজরে আসওয়াদ চুম্বন এবং রুকনে ইয়ামানীর স্পর্শ আমাদের কোনো প্রকার লাভ কিংবা ক্ষতি করতে পারবে না। লাভ-ক্ষতির মালিক একমাত্র আল্লাহ। এ বিষয়ে একমাত্র তাঁরই রয়েছে সর্বময় ক্ষমতা।

যদি এই বিশ্বাসে কোনো ত্রুটি আসে তাহলে তা শিরক হবে, যা বাইতুল্লাহ প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যকেই ব্যহত করবে। তাই আমাদের সবাইকে এই ভ্রান্ত বিশ্বাস থেকে যে কোনো মূল্যে বেঁচে থাকতে হবে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকর সিদ্দীক রাযি.-কে নবম হিজরীতে হজ্বে পাঠিয়েছিলেন। হজ্বের উদ্দেশ্যে সমবেত মানুষদেরকে তিনি এই ঘোষণা শোনাতে বললেন যে, কোনো মুশরিক এবছরের পর হজ্ব করবে না। কেউ উলঙ্গ অবস্থায় বায়তুল্লাহর তাওয়াফও করবে না’ ( বুখারী ও মুসলিম)।

হজ্ব তাওহীদী আকীদাকে দৃঢ় ও মজবুত করে, শিরক বর্জনের মানিসকতায় সৃষ্টি করে নতুন উত্তাপ। ইরশাদ হয়েছে:

{ ذلِكَ وَمَن يُعَظّمْ حُرُمَاتِ اللَّهِ فَهُوَ خَيْرٌ لَّهُ عِندَ رَبّهِ وَأُحِلَّتْ لَكُمُ الأنْعَامُ إِلاَّ مَا يُتْلَى عَلَيْكُمْ فَاجْتَنِبُواْ الرّجْسَ مِنَ الأوْثَانِ وَاجْتَنِبُواْ قَوْلَ الزُّورِ }

‘ এটিই বিধান। আর কেউ আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত পবিত্র বিষয়সমূহকে সম্মান করলে তার রবের নিকট তাই তার জন্য উত্তম। আর তোমাদের জন্য হালাল করা হয়েছে চতুষ্পদ জন্তু, তবে যা তোমাদের কাছে পাঠ করা হয় তা ছাড়া। সুতরাং মূর্তিপূজার অপবিত্রতা থেকে বিরত থাক এবং মিথ্যা কথা পরিহার কর’ (সূরা আল হাজ্জ:৩০)।

হজ্ব পালনকারীদের আরেকটি বিষয় সম্পর্কে অবগতির প্রয়োজন। তা হলো, হজ্বরত অবস্থায় হজ্বের কার্যাবলী যথাযথভাবে সম্পাদন করলে যেমন পুরস্কারের ঘোষণা দেয়া হয়েছে, তেমনি তাতে অবহেলা বা ত্রুটি করলেও কঠোর ধমক ও সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা হজ্বের বিধি-বিধান বর্ণনা করার পর বলেছেন:

{ ذلِكَ لِمَن لَّمْ يَكُنْ أَهْلُهُ حَاضِرِى الْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَاتَّقُواْ اللَّهَ وَاعْلَمُواْ أَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ }

‘ এ নির্দেশ তাদের জন্য, যাদের পরিবার-পরিজন মসজিদুল-হারামের আশে-পাশে বসবাস করে না। আর আল্লাহ্কে ভয় কর। এবং জেনে রাখো, নিশ্চয় আল্লাহ্ আযাবদানে কঠোর’ (সূরা বাকারা: ১৯৬)।

এখানে আল্লাহ তা‘আলা একথা বলেননি যে, নিশ্চয় আল্লাহ পরম দয়াশীল। বরং বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ আযাবদানে কঠোর। এভাবে বলার কারণ হলো, লোকজন যাতে হজ্বের সম্মান যথাযথভাবে বজায় রাখে এবং তাকে পরিপূর্ণভাবে আদায় করে। আর ধমক তো শুধু অবহেলাকারিদের জন্যই।

হাজীদের আরো একটি বিষয় অবগত হওয়া প্রয়োজন। তা হলো, গরিব ও অভাবগ্রস্থদের কথা বিবেচনায় রাখা। ইরশাদ হয়েছে:

{ لّيَشْهَدُواْ مَنَافِعَ لَهُمْ وَيَذْكُرُواْ اسْمَ اللَّهِ فِى أَيَّامٍ مَّعْلُومَاتٍ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مّن بَهِيمَةِ الأنْعَامِ فَكُلُواْ مِنْهَا وَأَطْعِمُواْ الْبَائِسَ الْفَقِيرَ }

‘ যাতে তারা তাদের কল্যাণের স্থান পর্যন্ত পৌঁছে এবং নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহ্র নাম স্মরণ করে তাঁর দেওয়া চতুষ্পদ জন্তু যবেহ্ করার সময়। অতঃপর তোমরা তা থেকে আহার কর এবং দুঃস্থ-অভাবগ্রস্তকে আহার করাও’ (সূরা-হাজ্জ: ২৮)।

অন্য আয়াতে তিনি বলেছেন:

{ فَكُلُواْ مِنْهَا وَأَطْعِمُواْ الْقَانِعَ وَالْمُعْتَرَّ كَذالِكَ سَخَّرْنَاهَا لَكُمْ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ }

‘অতঃপর তোমরা আহার কর এবং আহার করাও যে কিছু যাঞা করে না তাকে এবং যে যাচ্ঞা করে তাকে। এমনিভাবে আমি এগুলোকে তোমাদের বশীভূত করে দিয়েছি, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর’ (সূরা-হাজ্জ: ৩৬)।

মুসল্লিয়ানে কেরাম! হজ্বের শিক্ষণীয় বিষয় থেকে আরো একটি বিষয় হলো, হজ্ব তাকওয়া বা পরহেযগারী অবলম্বন করার গুরুত্ব এবং বান্দার আমলে তার সীমাহীন প্রভাবের বিষয়টি সুস্পষ্ট করে দেয়।

তাকওয়া হলো ঐ মাপকাঠি, যদ্বারা আমল ওজন করা হয়। অনুরূপভাবে তার মাধ্যমে মানুষের মর্যাদাও নিরুপন করা হয়। একারণেই হজ্ব সম্পর্কিত আয়াতগুলোতে তাকওয়ার ব্যাপারে অধিক পরিমাণে ওসিয়ত করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

{ وَاتَّقُواْ اللَّهَ وَاعْلَمُواْ أَنَّ اللَّهَ شَدِيدُ الْعِقَابِ }

‘আর আল্লাহ্কে ভয় কর। এবং জেনে রাখো, নিশ্চয় আল্লাহ্র আযাবদানে কঠোর’ (সূরা-বাকারা:১৯৬)।

আল্লাহ তা‘আলা অন্যত্র বলেন :

{ وَتَزَوَّدُواْ فَإِنَّ خَيْرَ الزَّادِ التَّقْوَى وَاتَّقُونِ ياأُوْلِي الألْبَابِ }

‘আর তোমরা পাথেয় গ্রহণ কর। নিশ্চয় সর্বোত্তম পাথেয় তাকওয়া। আর হে বিবেকসম্পন্নগণ, তোমরা আমাকে ভয় কর’ (সূরা বাকারা:১৯৭)।

তিনি আরো বলেন :

{ فَمَن تَعَجَّلَ فِى يَوْمَيْنِ فَلا إِثْمَ عَلَيْهِ وَمَن تَأَخَّرَ فَلا إِثْمَ عَلَيْهِ لِمَنِ اتَّقَى }

‘অতঃপর যে তাড়াহুড়া করে দ’ুদিনে চলে আসবে, তার কোনো পাপ নেই। আর যে বিলম্ব করবে তারও কোনো অপরাধ নেই। এ বিধান তাদের জন্য যারা তাকওয়া অবলম্বন করেছে। আর তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর এবং জেনে রাখ, নিশ্চয় তোমাদেরকে তাঁরই কাছে সমবেত করা হবে’ (সূরা আল-বাকারা: ২০৩)।

অন্য এক আয়াতে তিনি বলেন:

{ ذلِكَ وَمَن يُعَظّمْ شَعَائِرَ اللَّهِ فَإِنَّهَا مِن تَقْوَى الْقُلُوبِ }

‘এটাই হলো আল্লাহর বিধান যে আল্লাহর নিদর্শনসমূহকে সম্মান করে, নিঃসন্দেহে তা অন্তরের তাকওয়া থেকেই’ (সূরা হজ্জ: ৩২)।

তিনি আরো বলেন :

{ لَن يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلاَ دِمَاؤُهَا وَلَاكِن يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنكُمْ }

‘আল্লাহ্র কাছে পৌঁছে না এগুলোর গোশত ও রক্ত, বরং তাঁর কাছে পৌঁছে তোমাদের তাকওয়া’ (সূরা আল-হজ্জ: ৩৭)।

বস্তুত তাকওয়া হলো সকল কল্যাণের আধার।

প্রিয় ভাইয়েরা! আল্লাহ তা‘আলার দরবারে মানুষের মর্যাদা ও পরিচয় ভাষা, বর্ণ, দৈহিক আকৃতি ও দেশের ভিত্তিতে হয় না। বরং তা হয় একমাত্র তাকওয়ার ভিত্তিতে। যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন:

{ إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عَندَ اللَّهِ أَتْقَاكُمْ }

‘নিশ্চয় তোমদের মধ্যে আল্লাহ্র কাছে সে-ই সর্বাধিক সম্মানিত যে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক তাকওয়াসম্পন্ন’ (সূরা হুজুরাত: ১৩)।

আল্লাহর বান্দাগণ! তাকওয়ার ভিত্তিতেই মানুষ মর্যাদার সুউচ্চ আসনে সমাসীন হয় এবং এর দ্বারাই সে অর্জন করে বুযুর্গী ও শ্রেষ্ঠত্ব। যেমন সুহাইব ও সালমান ফারসী রাযি.।

পক্ষান্তরে মানুষের মধ্যে যদি তাকওয়া না থাকে তাহলে তার অপমান ও অপদস্থতা সুনিশ্চিত হয়ে যায় এবং আল্লাহ তা‘আলা তাকে লাঞ্ছিত ও বেইজ্জত করেন। যেমন তিনি শিরক ও কুফরীর কারণে আবু লাহাবকে লাঞ্ছিত করেছেন। করেছেন সীমাহীন অপমানিত। আর তাকওয়ার কারণেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বীয় ফুফাতো বোন জয়নব বিনতে জাহ্শকে যায়েদ ইবন হারেসা রাযি. এর সাথে বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ করেন। অথচ যায়েদ ইবন হারেসা রাযি. ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর আযাদকৃত দাস।

হজ্বের আরেকটি রহস্য ও তাৎপর্য হলো, তা এ উম্মতকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানায়।

হজ্বের সময় হাজীগণ একই স্থানে একত্রিত হন এবং একই সাথে আল্লাহ তা‘আলার ইবাদতে নিমগ্ন হন। নামায আদায় এবং সিয়াম সাধনার ক্ষেত্রেও মুসলমানগণ ঐক্যের পরিচয় দেন। মষ্টিগত এই ইবাদতগুলো মুসলিম উম্মাহকে সাম্য ও ঐক্যের শিক্ষা দেয়। সেই সাথে এও জানিয়ে দেয় যে, এ জাতি কখনো সফল হতে পারবে না যদি না তারা ঐক্যবদ্ধ হয়।

একথা আজ দিবালোকের ন্যায় পরিস্কার যে, বর্তমানে মুসলমানদের উপর কাফির-মুশরিকরা যে আগ্রাসন চালাচ্ছে তা কেবল তাদের দ্বিধা বিভক্তি ও ঐক্যহীনতার কারণেই। যেমন আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বলেন:

{ وَلاَ تَنَازَعُوا فَتَفْشَلُوا وَتَذْهَبَ رِيحُكُمْ }

‘আর তোমরা পরস্পর বিবাদে লিপ্ত হয়ো না। তাহলে তোমরা সাহসহারা হয়ে যাবে এবং তোমাদের শক্তি নিঃশেষ হয়ে যাবে’(সূরা আল-আনফাল: ৪৬)।

হজ্বের বৈশিষ্ট্য ও শিক্ষণীয় বিষয়ের মধ্যে এটিও একটি যে, হজ্ব ঈমানকে নতুনত্ব দান করে, আত্মাকে সংশোধন করে এবং বিভিন্ন প্রকার আত্মিক ব্যাধি ও কুপ্রবৃত্তি থেকে রক্ষা করে। হজ্বের সময় তাওহীদ বা একত্ববাদের বুলন্দ আওয়াজ যমীনকে প্রকম্পিত করে এবং হাজীগণ মশগুল হয় বিভিন্ন প্রকার ইবাদতে যা তাদের গুনাহসমূহকে মিটিয়ে দেয় এবং ছাওয়াবকে বর্ধিত করে। হাদীসে এসেছে:

( مَنْ حَجَّ فَلَمْ يَرْفُثْ وَلَمْ يَفْسُقْ رَجَعَ مِنْ ذُنُوْبِهِ كَيَوْمَ وَلَدَتْهُ أُمُّهُ )

‘যে ব্যক্তি হজ্ব করল এবং কোনোপ্রকার অশ্লীল ও শরীয়তবিরোধী কাজে লিপ্ত হলো না, তবে সে গোনাহ থেকে পবিত্র হয়ে এমনভাবে ফিরে আসবে, যেমন ছিল তার জম্মদিবসে’ (বুখারী)।

হজ্বের তাৎপর্যসূহের মধ্যে এটিও একটি যে, হজ্ব কাফির সম্প্রদায়ের নিকট এ মর্মে পত্র প্রেরণ করে, হে কাফির ও অমুসলিম সম্প্রদায়! তোমরা চেয়ে দেখো মুসলিম জাতি তাদের ধর্ম পালনে কত অবিচল ও সুশৃঙ্খল! কত মজবুত ও অটল!! এতে কাফিরগোষ্ঠী ভীত-সন্তস্ত্র হয় এবং মুসলমানদের তারা ভয় পায়। তারা মুসলমানদের সামনে মাথা উঁচু করে কথা বলার সাহস পায় না। তারা হয়ে যায় বাকশক্তিহীন ।

بَارَكَ اللهُ لِيْ وَلَكُمْ فِي الْقُرْآن الْعَظِيْمِ وَنَفَعَنِيْ وَإِيَّاكُمْ بِمَا فِيْهِ مِنَ الْآياتِ وَالذِّكْر الحْكِيْم، أقُوْلُ قَوْلِيْ هَذَا وَأَسْتَغْفِرُ اللهَ لِيْ وَلَكُمْ فَاسْتَغْفِرُوهُ إِنَّهُ هُو الْغَفُور الرَّحِيْمْ .

الحمد لله رب العالمين، والصلاة والسلام على أشرف المرسلين وعلى آله وأصحابه أجمعين، أما بعد:

মুহতারাম হাযেরীন! হজ্বের আরেকটি তাৎপর্য হলো, হজ্ব মানুষকে আখেরাতের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এবং সেই কঠিন দিবসের ব্যাপারে সতর্ক করে। আল কুরানে ইরশাদ হয়েছে:

{ رَبَّنَا إِنَّكَ جَامِعُ النَّاسِ لِيَوْمٍ لاَّ رَيْبَ فِيهِ }

‘হে আমাদের রব! নিশ্চয় আপনি এমন এক দিনে লোকদেরকে সমবেত করবেন যেদিনের ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই’ (সূরা আল ইমরান: ৯)।

আরাফার দিনকে একটি ছোটোখাটো কিয়ামতের দিনই বলা যায়। এ দিনটি মানুষকে একথা স্মরণ করিয়ে দেয় যে, যেমনিভাবে তোমরা আজকের এই দিনে আরাফার ময়দানে উপস্থিত হয়েছ, ঠিক তেমনি তোমাদেরকে ভীত-সন্তস্ত্র ও ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে একদিন মহান আল্লাহর দরবারে উপস্থিত হতে হবে।

হজ্ব হলো সম্মিলিতভাবে ইবাদত করার এমনি এক বিশাল চিত্র, যা ইতিপূর্বে অন্য কোনো উম্মতকে দেয়া হয়নি। যা এই উম্মতের শ্রেষ্ঠত্ব ও স্থায়িত্বের প্রমাণ বহন করে। উপরন্ত হজ্ব মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্ককে সুদৃঢ় করে এবং বৃদ্ধি করে মহব্বত ও ভালোবাসা।

হজ্ব ইসলামের পঞ্চম রুকন এবং সুদূরপ্রসারী গভীর তাৎপর্যপূর্ণ একটি ইবাদত।

হজ্বের বিধান যেমন একাধারে যুগ ও কালের সকল সীমানা পেরিয়ে সমগ্র মানবজাতির মনে ঐতিহ্য-চেতনা অম্লান করে রাখে, তেমনি সকল ভৌগলিক সীমারেখা অতিক্রম করে এক আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে মানবজাতির ঐক্য ও অভিন্নতার অনুভূতি জাগ্রত করে দেয়। ভাষা, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে সকল মানুষই যে একে অপরের সাথে একটা অভিন্ন ভ্রাতৃত্ববন্ধনে আবদ্ধ এ মনোভাব সৃষ্টিতে হজ্ব যে তুলনাবিহীন একটি অনুষ্ঠান, এ সত্য অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

হজ্ব মানবজাতির জন্য একটি বহুমুখী উপকারী ইবাদত এই ইঙ্গিত পবিত্র কুরআনে রয়েছে। এসবের যে কোনো একটি দিক নিয়ে চিন্তাভাবনা বৃহৎ একটি গ্রন্থের পরিসর সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া স্থল ও সমুদ্র পথের সীমাহীন কষ্টসাধ্য সফরে মানুষকে উদ্বুদ্ধকরণের ক্ষেত্রে হজ্বের অবদান স্মরণীয়।

হজ্বের সমাবেশে দুনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক অবস্থান এবং কুশলাদি সম্পর্কিত তথ্য বিনিময়, প্রত্যেক অঞ্চলের সমস্যাদি সম্পর্কে পরামর্শ ও সমাধানের ব্যাপারে একে অন্যের সহযোগিতার পন্থা উদ্ভাবন প্রভৃতিও কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়।

(إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آَمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ، اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ

হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে হজ্বের প্রকৃত শিক্ষা ও তাৎপর্য ভালোভাবে হৃদয়ঙ্গম করে আপনার মর্জি অনুযায়ী হজ্ব আদায় করার তাওফীক দান করুন। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে সকল প্রকার বালা-মুসিবত ও বিপদ-আপদ থেকে হেফাযত করুন। আমাদের অভাব দূর করে দিন। আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষিকর্মে বরকত দিন। আমাদেরকে হালাল কামাই করার তাওফীক দিন।

عبَادَ اللهِ رَحمِكُمُ الله :(إِنَّ اللهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ والإحْسَانِ وَإيْتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالمْنْكَرِ وَالْبَغْيِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُوْنِ) اُذْكُرُوا اللهَ يَذْكُرْكُمْ وَادْعُوْهُ يَسْتجِبْ لَكُمْ وَلَذِكْرُ اللهِ تَعَالَى أَعْلَى وَأَعْظَمُ وَأَكْبَرُ.





كلمات دليلية:




ইসলামী শরিয়তের বৈশিষ্ট্য